মো.মুজিবুর রহমান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টেলিটক।
* থ্রিজি চালু হওয়ার পর আপনাদের প্রবৃদ্ধি কেমন হয়েছে?
** থ্রিজি চালুর আগে আমাদের ১৪ থেকে ১৫ লাখ গ্রাহক ছিল, এখন ২০ লাখ হয়ে গেছে। আশা করছি ডিসেম্বর নাগাদ ২৫ লাখ হবে। বর্তমানে পাঁচ লাখের মতো থ্রিজি গ্রাহক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি বলা যায় ২৫ শতাংশ। এটা ভারতের চেয়েও অনেক ভালো প্রবৃদ্ধি। আমরা চাই থ্রিজি নিয়ে প্রতিযোগিতা হোক। তাহলে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে আরো ভালো সেবা দিতে পারব।
* টেলিটক থ্রিজি নেটওয়ার্কের বর্তমান পরিস্থিতি কি?
** আমরা দ্রুত সারা দেশে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছি। আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে সব বিভাগেই থ্রিজি চালু করছি। এছাড়া অনেক জেলা শহরেও আমাদের থ্রিজি সেবা চালু হয়েছে। আগে আমাদের বিটিএসের সংখ্যা অনেক কম ছিল। এখন আমরা বিটিএস প্রতিদিন বাড়াচ্ছি। আগে যেখানে আমাদের বিটিএস ছিল মাত্র ৬৩০টি এখন ৩ হাজার বিটিএস যুক্ত হয়েছে টেলিটকের নেটওয়ার্কে। আরো এক থেকে দেড় হাজার বিটিএস যোগ হবে। আগে যেখানে আমাদের সুইচিং ক্যাপাসিটি ছিল মাত্র আড়াই লাখ এখন তা প্রায় এক কোটি। আমাদের সব লিংক আমরা আপগ্রেড করেছি। প্রিপেইড এবং পোস্ট পেইডে এখন আমরা কম্বাইন্ড বিলিং সিস্টেম চালু করেছি, যার ফলে আমরা একই রকম সেবা প্রিপেইড এবং পোস্ট পেইডে দিতে পারব, যা অন্য অপারেটরদের পক্ষে সম্ভব না। আমাদের ভয়েস কোয়ালিটি ল্যান্ডফোনের কাছাকাছি চলে এসেছে, যা অন্য অপারেটররা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি।
* টেলিটকের থ্রিজি সেবা দিতে কীভাবে কাজ করছে?
** থ্রিজি সেবা সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে কারিগরি সমস্যা না হয়, এ জন্য আমাদের টেকনিক্যাল টিম দিন-রাত কাজ করেছে। থ্রিজির কাজ করতে গিয়ে প্রথমে আমাদের ৮ থেকে ১০ হাজার গ্রাহক সমস্যায় পড়েছিল। তাদের সিম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর তাদের আমরা নতুন সিম দিয়েছি বিনা পয়সায়। এ ছাড়া আর বড় কোনো সমস্যা হয়নি। আমাদের কাজে বেশির ভাগ গ্রাহকই খুশি। টেলিটক বাংলাদেশি কোম্পানি, আমাদের প্রকৌশলী, কর্মীবাহিনী এ দেশের। অন্য কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন যেখানে বাইরে থেকে হয় সেখানে আমরা স্থানীয় লোকজন দিয়েই তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছি। আমাদের দেশীয় প্রতিভা বিশ্বমানের হয়ে গেছে।
* থ্রিজি গ্রাহক সেবা দেওয়ার জন্য আপনারা কি করছেন?
** ঢাকায় বেশ কিছু গ্রাহক সেবাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে এবং আমাদের কল সেন্টারে আপিসিসি স্থাপন করেছি, যা শীঘ্রই উদ্বোধন করা হবে। ফলে গ্রাহকরা আরো ভালো সেবা পাবে। আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে সব বিভাগীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরে থ্রিজি সেবা উন্মুক্ত করবে টেলিটক। থ্রিজির সুবিধা আগে শুধু ঢাকার মানুষ পেত, এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষও পাবে। এ জন্য ঢাকার বাইরেও গ্রাহক সেবা দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
* থ্রিজি চালুর ফলে দেশের মানুষ কি ধরণের সুবিধা ভোগ করছে?
** আমরা আখ চাষিদের জন্য ই-পুর্জি সেবা চালু করেছি। এখন তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। ৬১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়া টেলিটকে সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে শত শত টন কাগজ, যাতায়াত খরচ সাশ্রয় হচ্ছে এবং মানুষের সময় বাঁচছে। আরইবির বিলও টেলিটকের মাধ্যমে জমা দেওয়া হচ্ছে। ৭০টি সমিতির মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছে। আমাদের ইকোসিস্টেমের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিল তা কিছুটা হলেও টেলিটক রক্ষা করছে। ছোট একটি কোম্পানি হলেও লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল সরবরাহ করছে এটাও কম কথা নয়। উপজেলা তথ্য বাতায়নেও টেলিটক স্বল্পমূল্যে সেবা দিয়ে আসছে। থ্রিজির মাধ্যমে মোবাইল অ্যাডভার্টাইজিং শুরু করবে টেলিটক। ছোট উদ্যোক্তারা নিজ নিজ পণ্য ও সেবার প্রচার কম খরচে করতে পারবেন। এভাবে থ্রিজি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা মানুষের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করব।
* আপনাদের থ্রিজি রাউটার ও ডঙ্গল সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
** আমাদের ৩৫ হাজার ডঙ্গল যেখানে ৬ মাস চলার কথা ছিল তা ২ মাসেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা থ্রিজি রাউটার আনছি, যা ল্যাপটপ-আইপ্যাড ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া আরো সাশ্রয়ী মূল্যে থ্রিজি ডঙ্গল বাজারে ছাড়া হবে শীঘ্রই। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা লাভের চেয়ে মানুষের সুবিধার কথা চিন্তা করি। ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসেও আমরা সবচেয়ে কম মূল্য নিচ্ছি। এসব নামমাত্র মূল্যের সেবায় কিন্তু বড় অপারেটররা আসছে না। তারা জানে, এখানে খুব বেশি লাভ হবে না। এসব সেবা বিদেশি কোম্পানি না দিলেও আমরা দিয়ে যাব।
* ইন্টারনেটের মূল্য কমানোর জন্য আপনারা কি কিছু করছেন?
** আমরা প্রতি ৩ মাস অন্তর বাজার পর্যালোচনা করছি এবং সে অনুযায়ী সেবা মাশুলও কমাচ্ছি। এ ছাড়া ব্যান্ডউইথ খরচ এবং এনবিআর ট্যাক্স কমলে আমরা ইন্টারনেট খরচ আরো কমাতে পারব।
* টেলিটক সম্পর্কে অনেক অভিযোগের কথা শোনা যায় সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
** টেলিটক সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও আমাদের এখানে দুর্নীতি বা অনিয়ম নেই। বাইরের অপারেটরদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে যদি কোম্পানির ক্ষতি ভেতর থেকে কেউ করার চেষ্টা করে, আমরা অবশ্যই তাকে ধরার চেষ্টা করব। কারণ এ প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। টেলিটক একমাত্র দেশি কোম্পানি। আমরা যত ভালো করতে পারব, দেশ তত লাভবান হবে। বাইরেও সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। সুযোগ পেলে প্রতিবেশী দেশেও আমরা টেলিটকের থ্রিজি সেবা সম্প্রসারণ করতে পারব। বাংলাদেশের যে সক্ষমতা আছে তাতে আমরা আঞ্চলিক পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে পারি। মিয়ানমার ও নেপালে অনেক বেশি সম্ভাবনা আছে আমাদের জন্য। আমাদের পর্যাপ্ত টাকা থাকলে আমরা মিয়ানমারে নিলামে অংশ নিতাম। কারণ আমাদের সে সক্ষমতা আছে। টেলিটক নিয়ে শুধু দেশে সীমাবদ্ধ থাকার চিন্তা নেই, এটিকে আমরা আঞ্চলিকভাবে ছড়িয়ে দিতে চাই।
* বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
** গত সাড়ে চার বছরে দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যা অতীতে হয়নি। আগে টেলিডেনসিটি ছিল ৪৩ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৩ কোটির ওপরে। থ্রিজিসহ অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি এখন মানুষের হাতের নাগালে। শহর থেকে গ্রাম সব ক্ষেত্রে আধুনিক টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। ফলে শিক্ষা, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমরা এখন অনেক অগ্রসর। তুলনামূলক কম সময়ে টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে বিরাট এক বিপ্লব ঘটেছে।
* টেলিটকের অগ্রযাত্রা কতটা সফল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
** আমাদের দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সফলতা কম। এর পেছনে অবশ্য অনেক কারণও আছে। এক্ষেত্রে টেলিটক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সততা, নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি আমরা। বর্তমানে ২০ লাখের মতো গ্রাহক রয়েছে টেলিটকের। এ সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য এলাকার মানুষ টেলিযোগাযোগের সেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। ওইসব দুর্গম এলাকায় টেলিটকই প্রথম মোবাইল ফোন সুবিধা নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে সেখানে ২৫টি উপজেলার সব এলাকাতে রয়েছে টেলিটকের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এছাড়া আধুনিক থ্রিজি সেবা, তুলনামূলক কম খরচে গ্রাহকের কাছে উন্নত সেবা পৌঁছে দিচ্ছে টেলিটক। সবদিক বিবেচনা করে উন্নত টেলিযোগাযোগ সেবায় টেলিটক শত ভাগ সফল বলে আমি মনে করি।
* অনেকেই টেলিটকের থ্রিজি সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
** এটি মোটেও ঠিক নয়। কেউ বলে থাকলে তা তার ব্যক্তিগত মতামত। আমরা এটিকে সাধুবাদ জানাই। তবে আমি বলব আমরা শতভাগ সফল। আসলে ভালোর কোনো শেষ নেই। সবসময় যে বিষয়টি আমরা খেয়াল রাখি তা হল তুলনামূলক কম খরচে কীভাবে উন্নত গ্রাহকসেবা দেওয়া যায়। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে টেলিটকের কর্মীরা প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। থ্রিজির বিষয়ে আমি বলব, ওটা ছিল পরীক্ষামূলক যাত্রা। এ যাত্রার মাধ্যমে আমরা অনেক কিছুই শিখেছি। যেখানেই সমস্যা সেখানেই দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দিনে দিনে সেবার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
* অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার ব্যাপারে টেলিটকের অবস্থান কী?
** আমরা সবসময় ভিওআইপির বিরুদ্ধে। বিটিআরসিকে সব ধরনের সহায়তা দিতে টেলিটক প্রস্তুত। টেলিটকের কোনো নম্বর ভিওআইপির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওই গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। এ ব্যাপারে আমরা কোনো কম্প্রোমাইজ করি না।
* টেলিটকের সেবার মান বাড়াতে আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
** গ্রাহকদের আধুনিক প্রযুক্তি সেবা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ চলছে প্রতিনিয়ত। আমরা গ্রাহকদের খুব কাছাকাছি যেতে চাই। সেজন্য সারাদেশে টেলিটকের কাস্টমার কেয়ার বৃদ্ধি করা হচ্ছে। যেখানে থাকবে অত্যাধুনিক ইন্টারনেট প্রটোকল। এর ফলে কোনো ভুয়া গ্রাহক সুবিধা নিতে পারবে না। এছাড়া কাস্টমার কেয়ারগুলোতে কিছু কিছু জরুরি তথ্য যাতে গ্রাহকরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেতে পারেন সে সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। উন্নত সেবার পাশাপাশি গ্রাহকের খরচের বিষয়টিও মাথায় রেখে সুলভ মূল্যে সহজবোধ্য প্যাকেজ চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ‘ইয়ুথ’ নামে নতুন একটি প্যাকেজ চালু করেছি। এ প্যাকেজে এত বেশি সুবিধা রয়েছে-যা এর আগে অন্য কোনো অপারেটর দেয়নি।
* আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
** আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment